হুমকি চলছেই-সাইবার বুলিং-আতঙ্কে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা!

বাংলার আলো ডেস্ক: আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো অনলাইনে প্রকাশ করে হয়রানির মাধ্যমে ভীতি সৃষ্টি করছেন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা, এমনটিই দাবি ভুক্তভোগীদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ভুক্তভোগী কাওসার হামিদ বলেন, আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা শেখ মুজিবের একটি ম্যুরাল ভাঙচুর করেছিল। এ ঘটনার পর থেকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অনবরত আমাদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। অনলাইন, অফলাইন এমনকি আমাদের বাবা-মায়ের ফোন নম্বরে পর্যন্ত কল করে হুমকি দিচ্ছেন।

‘আমার ভাইবোনের জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি ও নম্বরসহ অনেক ব্যক্তিগত তথ্য তারা বের করছে। সেগুলো ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। জগন্নাথ হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীব বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সম্পাদক মেহেদী হাসান শান্তসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা এসব কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছে।’

আরেক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সুলাইমান আলী বলেন, যেসব নম্বর থেকে ফোনকল করা হচ্ছে তার কয়েকটি বাংলাদেশের। বাকিগুলো বাইরের। তারা কল দিয়ে এত জঘন্য ভাষায় গালাগালি করে যেগুলো মুখে নেওয়ার মতো নয়। নারী শিক্ষার্থীসহ সবাইকে এক এক করে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করে। পরে সেখানে একসঙ্গে অনেকজন মিলে গালিগালাজ করে। তারা নারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ফেক ছবি এবং ভিডিও বানিয়ে সেগুলো অনলাইনে ছেড়ে দিচ্ছে, যা ওই শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর।

আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য-প্রমাণসহ শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। জিডিতে তারা ৩০টি ফেসবুক আইডি এবং ১০টিরও বেশি দেশি-বিদেশি নম্বর উল্লেখ করেন, যেগুলো থেকে তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। জিডিটি বর্তমানে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটে প্রক্রিয়াধীন।

জানা যায়, আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতো একই ঘটনা ঘটে ‘অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট কোয়ালিশন’ নামের একটি সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গেও। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবের গ্রাফিতি নতুন করে এঁকেছিলেন এবং সেখানে জুতা নিক্ষেপ কর্মসূচি করেছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিসা ইসলাম সাকাফিও সাইবার বুলিং ও হুমকির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

এছাড়া সম্প্রতি চট্টগ্রাম, গাজীপুর, রংপুর, গোপালগঞ্জসহ সারাদেশে প্রথমে হুমকি এবং পরবর্তীসময়ে হামলার ঘটনা দৃশ্যমান হচ্ছে, যা একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন অনেকে।

যা বলছে ছাত্র সংগঠনগুলো
অনলাইন ও অফলাইনে অনবরত হুমকি ও বুলিংয়ের ব্যাপারে ছাত্র সংগঠনগুলো কী ভূমিকা পালন করছে বা আগামীতে তাদের কী ভূমিকা হবে তা জানার চেষ্টা করেছে জাগো নিউজ।

জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, এত বড় একটা আন্দোলনের ছয় মাস পরও শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন, কিন্তু আইটি বিভাগে যারা সংশ্লিষ্ট তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। এটি আসলেই অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ব্যাপারে তাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

‘তবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা যদি তাদের একটি হুমকিও বাস্তবায়নের চেষ্টা করে তাহলে ছাত্রদল সামনে থেকে সেটি প্রতিহত করবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য যা করার ছাত্রদল সাংগঠনিকভাবে তা করবে’- বলেন ছাত্রদল সভাপতি।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক আবু সাদিক কায়েম বলেন, এখনো সাইবার বুলিংয়ের বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক। আমি নিজেও এর ভুক্তভোগী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব দমাতে অসহযোগিতামূলক আচরণ করছে। আমি নিজেও থানায় জিডি করেছিলাম, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেই এদের শনাক্ত করতে পারে, কিন্তু তারা তা করছে না।

তিনি বলেন, যদি কয়েকজনকে গ্রেফতার করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যেত তাহলে এগুলো কমে যেত। ছাত্র সংগঠন হিসেবে আমাদের উচিত হবে নিজ নিজ দলের নেতাকর্মীদের সংযত রাখা। যেন আমাদের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট না হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং প্রশাসনের দায়িত্ব। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তারা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে আমরা মনে করি।

‘তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেহেতু আন্দোলন থেকেই গড়ে ওঠা, তাই এর দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমরা অনেকগুলো সেল তৈরি করেছি। লিগ্যাল সেল আছে, হটলাইন নম্বরও আছে। এগুলোর মাধ্যমে যারা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন তাদের আইনি সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে’- বলেন তিনি।

গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো অব্যাহতভাবে সাইবার বুলিং ও প্রাণনাশসহ নানান ধরনের হুমকির শিকার হচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা। এর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না অভ্যুত্থানের পক্ষের সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীও। এ অবস্থায় অনেকেই মানসিকভাবে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি জেলা-উপজেলার ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। সম্প্রতি ফোনকলে হত্যা ও পরিবারের ক্ষয়ক্ষতির হুমকি, সামাজিক মাধ্যমে হয়রানি ও ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে হয়রানিসহ নানান হুমকির ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কোনো কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *