ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় প্রতিনিধি: প্রেম না মানে ধর্ম। প্রায় দেড় বছর আগে ঘুরতে গিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে দেখা থেকেই ভালোলাগা। ধর্ম ভিন্ন হলেও একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেন তারা। ভালোবাসার জন্য ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তনুশ্রী দাস থেকে হয়ে যান সিদরাতুল মুনতাহা। ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করেন প্রেমিক কবির হোসেনকে। কিন্তু কিছু দিন সংসার হলেও এক সঙ্গে থাকা হয়নি তাদের।
হিন্দুধর্মাবলম্বীর মেয়ে হওয়ায় মুসলিম ছেলেকে বিয়ের বিষয়টি মানতে পারেননি তনুশ্রীর বাবা-মা। ছেলের বাড়িতে গিয়ে দুজনকে তুলে নিয়ে আটকে রাখেন বাড়িতে। এরপর ধর্ষণ ও অপহরণ মামলার আসামি করে তুলে দেন পুলিশের হাতে। এ মামলায় একদিন কারাগারে থাকলেও আদালতে স্ত্রীর জবানবন্দিতে ছাড়া পান কবীর। এরপর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে দেখার সুযোগ মিলছিল না তার। নানা নাটকীয়তার পর মেয়েকে মুসলিম ছেলের হাতে তুলে না দিতে কৌশলে ভারতে নিয়ে যাচ্ছিলেন ওই তরুণীর বাবা। কিন্তু সীমান্তে গিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন স্বামী কবির হোসেন।
রোববার (১৮ আগস্ট) দুপুরে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) আইসিপি চেকপোস্টে অভিযোগ নিয়ে হাজির হন কবির হোসেন। এসময় নব মুসলিম তরুণী সিদরাতুল মুনতাহা (তনুশ্রী দাস) পরিবারের কাছ থেকে রক্ষা পেতে বিজিবির কাছে নিজের বিয়ের তথ্য ও কবির যে তার স্বামী তার প্রমাণ দিতে বিয়ের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট (নথি) উপস্থাপন করেন। পরে বিকেলে বিজিবি ও ইমিগ্রেশন পুলিশের সহায়তায় স্বামীর বাড়ি রংপুরে ফিরেছেন সিদরাতুল মুনতাহা। অবশেষে দীর্ঘ ১৫ মাস পর সীমান্তে ভালোবাসার জয় হলো এই দম্পতির।
জানা যায়, গত বছর ঘুরতে গিয়ে রংপুর কারমাইকেল কলেজের মাঠে রংপুর জেলার দর্শনা এলাকার কবির হোসেনের সঙ্গে দেখা হয় ঠাকুরগাঁও জেলার চন্ডিপুর এলাকার তরুণী তনুশ্রী দাসের। দেখা থেকেই ভালোলাগা। এক পর্যায়ে ফোন নম্বর দেওয়া-নেওয়া হয়। এভাবেই শুরু হয় দুজনের প্রেম। ৯ মাস প্রেমের সম্পর্কের পর তনুশ্রী ২০২৩ সালে বছরের ৫ জুন পরিবারের অমতে হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলমান হয়ে ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে কবির হোসেনকে বিয়ে করেন। ধর্মান্তরিত হয়ে নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন সিদরাতুল মুনতাহা। কয়েকদিন সংসারও করেন তারা। তবে বিয়ের কয়েকদিন পরই জেনে যায় তরুণীর পরিবার। মুসলমান ছেলের সঙ্গে বিয়ে মেনে নেননি তারা।
বিয়ের কয়েকদিন পর রংপুর থেকে তাদেরকে ঠাকুরগাঁওয়ে তুলে নিয়ে আসে তরুণীর পরিবার। পরে স্বামী কবিরকে আটক করে তার বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণ মামলা করলে সে মামলায় একদিন কারাবাসও করেন কবির। আদালতে তরুণীর জবানবন্দিতে মুক্তি পান তিনি। তবে আদালত থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তরুণীকে তার পরিবার মাইক্রোবাসে করে বাড়িতে নিয়ে আটকে রাখেন।
এদিকে কবির জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে অনেক খোঁজাখুজি করে পাচ্ছিলেন না স্ত্রীকে। পাগলের মতো স্ত্রীকে খুঁজেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। অবশেষে শনিবার গোপন সংবাদে জানতে পারে, তার স্ত্রীকে তার বাবা-মা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে নিয়ে যাবেন। এমন খবর পেয়ে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশনে ছুটে যান স্বামী কবির হোসেন। বিষয়টি তিনি সেনাবাহিনী, পুলিশ বিজিবিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে অবহিত করে বিজিবি চেকপোস্টে বিয়ের যাবতীয় ডকুমেন্টস দেখান।
এ সময় তরুণী বিজিবিকে তারা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ের করেছেন এমন জবানবন্দি দেন। তরুণী সিদরাতুল মুনতাহা স্বামী কবির হোসেনের সঙ্গে সংসার করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। পরে বিজিবি তরুণীর বাবা-মায়ের সামনেই কবিরের কাছে তার স্ত্রীকে তুলে দেন। বিজিবির সহযোগিতায় দীর্ঘ ১৫ মাস পর সিদরাতুল মুনতাহা ও কবির হোসেন এক হতে পেরে ধন্যবাদ জানান বিজিবিসহ সংশ্লিষ্টদের। সবার কাছে দোয়া চেয়ে বিকেলে মাইক্রোবাসে বাসে করে স্বামী কবির হোসেন তার স্ত্রীকে তার বাড়ি রংপুরে নিয়ে যান।
তরুণী সিদরাতুল মুনতাহা বলেন, আমার পরিবার পুলিশের মাধ্যমে আমাদের ঠাকুরগাঁও নিয়ে আসে। এরপর অনেক কিছু হয়ে যায়। ১ বছর ৩ মাস পর আমাদের আবার দেখা।
কবির হোসেন বলেন, আমার স্ত্রী ভারতে যেতে চান না। সে আমার সঙ্গে সংসার করতে চান। বিজিবি সদস্যদের সহযোগিতায় স্ত্রীকে ফিরে পেয়েছি। সবার কাছে দোয়া চাই আমরা যেন সুখে শান্তিতে সংসার করতে পারি।
কবিরের সঙ্গে আসা প্রতিবেশী মারুফ হাসান বলেন, তারা দুজন ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিল। কিন্তু মাঝে অনেক ঘটনা ঘটেছে। জীবনে অনেক ভালোবাসা দেখেছি কিন্তু এদের মতো ভালোবাসা দেখিনি।
তবে ওই সময় তরুণীর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তারা কথা বলতে চাননি। শুধু বলেছেন, মেয়ের ভালো চেয়েছিলাম। এ সময় তার মা ও বোনকেও কাঁদতে দেখা গেছে।