‘আন্দোলন দমনে’র ২৫ কোটি টাকা গেল কার কার পকেটে?

বাংলার আলো ডেস্ক: স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলের প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের কক্ষ থেকে ২৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে গত মাসে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, আলামত সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি। সিসি ক্যামেরা বন্ধ কেন, মনিরুলের কক্ষে কার কার প্রবেশাধিকার ছিল, কারা সেদিন প্রবেশ করেছিল, টাকা আদৌ কত ছিল, সরিয়েছে মূলত কারা— এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজছে ৪ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি।

এদিকে ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু করেছে সিআইডির ফরেনসিক টিমও। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে নেওয়া হচ্ছে বিশেষজ্ঞ মতামত।

মনিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা গেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। জানা যাবে এই ২৫ কোটি টাকা আনা ও সরানোর তথ্য। আমরা তাকে খুঁজছি। তিনি কোথায় আছেন তা এখনো নিশ্চিত নয়।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে ব্যয় করার জন্য গত ৩ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের কাছ থেকে ২৫ কোটি টাকা এনে নিজের কক্ষে রেখেছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার প্রধান মনিরুল ইসলাম। কিন্তু সেই টাকা বিতরণ করার আগেই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ওই দিন থেকে আর অফিসে যাননি মনিরুল। ফলে ওই টাকা সেখানেই থাকার কথা। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে, তার অফিসে কোনো টাকা নেই।

চার সদস্যের কমিটি গঠন

মনিরুল ইসলামের কক্ষ থেকে ২৫ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা জানাজানির পর পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রথমে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে আরও একজনকে ‘কোঅপ্ট’ করা হয় কমিটিতে।

চার সদস্যের কমিটির প্রধান পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়নের (এসপিবিএন) ডিআইজি গোলাম কিবরিয়া (অতিরিক্ত আইজিপি সুপার নিউমারারি)। বাকি তিন জনের সবাই ডিআইজি। একজন এসবির, বাকি দুজন এপিবিএনের। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া না হলেও কমিটিকে অবিলম্বে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

সন্দেহের তালিকায় ৩ জন

২৫ কোটি টাকা সরানোর ঘটনায় এসবির তিন কর্মকর্তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। তারা হলেন- তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি (অর্থ) মো. সরোয়ার, এসবির স্পেশাল সুপার (অর্থ) নজরুল ইসলাম ও স্টাফ অফিসার (এসপি মর্যাদা) মোহাম্মদ আশরাফ।

এসবি সূত্রে জানা গেছে, আঙুলের ছাপ দিয়ে এসবি প্রধানের কক্ষে ঢোকার প্রবেশাধিকার ছিল দপ্তরের পাঁচজনের। ৭ আগস্টের পর তাদের প্রত্যেকের সেই প্রবেশাধিকার লক করে দেন এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানেই টাকা সরানো হয় বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

সিসি ক্যামেরার সংযোগ বন্ধ করে টাকা লোপাট

এসবি প্রধানের মূল কক্ষের পেছনে একটি সিন্দুক রয়েছে। সেখানে মূলত রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডকুমেন্ট রাখা হয়। ওই সিন্দুকেই রাখা হতে পারে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সোর্স মানি হিসেবে আনা বিপুল পরিমাণ অর্থ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসবির কর্মকর্তারা জানান, ওই সোর্স মানি আনার তথ্যটি এসবি প্রধান মনিরুল ছাড়াও জানতেন ৪ থেকে ৫ জন কর্মকর্তা। তারাই যোগসাজশে এসবি কার্যালয়ের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ও ইন্টারনেট বন্ধ রেখে ৬ থেকে ১২ আগস্টের মধ্যে কোনো এক সময়ে মনিরুলের কক্ষ থেকে ওই টাকা সরিয়ে নেন।

টাকা সরানোর ঘটনায় সন্দেহভাজনদের জবানবন্দি নিয়েছে তদন্ত কমিটি। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে সেদিন এসবি প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত থাকা কর্মককর্তাদেরও। যাদের ওই কক্ষে প্রবেশাধিকার ছিল তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

যা বলছেন তদন্ত কমিটির প্রধান

আজ রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) তদন্ত কমিটির প্রধান গোলাম কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন,
কমিটির কাজ হলো এসবির সাবেক প্রধানের কক্ষে সেদিন প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, তা নির্ণয় করা। তদন্ত শেষে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে।

এখন পর্যন্ত কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারা সেদিন দায়িত্বে ছিলেন তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। ফরেনসিক টিম কাজ করছে। কারা সেদিন সিসিটিভির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল সেটিও খোঁজা হচ্ছে। যারাই জড়িত থাকুক না কেন তদন্তের ভিত্তিতে তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল কোথায়?

শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগ চলে যান আত্মগোপনে। একই পথে হাঁটেন আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে কাজ করা প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তারাও। এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামও আছেন পালিয়ে থাকাদের তালিকায়। তার নামে অন্তত দুই ডজন মামলা হয়েছে। যদিও এখনো তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

গত ১৩ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে প্রথমে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত এবং পরে পৃথক প্রজ্ঞাপনে মনিরুল ইসলামকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

মনিরুল এখন কোথায় আছেন— জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের অপারেশন উইংয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ছিলেন। তাকে সরকার বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অনেকগুলো মামলার আসামি তিনি। আসামি হিসেবেই আমরা তাকে খুঁজছি। এর মধ্যে তার অফিসের কক্ষ থেকে আন্দোলন দমনের নামে সরকারের কাছ থেকে আনা ২৫ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটে।

তিনি বলেন, মনিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা গেলে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে। জানা যাবে এই ২৫ কোটি টাকা আনা ও সরানোর তথ্য। আমরা তাকে খুঁজছি, তিনি কোথায় আছেন তা এখনো নিশ্চিত নই।

উল্লেখ্য, বিসিএস-১৫ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। তিনি শেখ হাসিনা সরকারের আমলে পুলিশের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন। তার স্ত্রী বিসিএস-১৭ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা সায়লা ফারজানা। সম্প্রতি তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *